পপি ফুল! যার অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে হয়তো আমাদের মধ্যে কোন ধরনের বিতর্ক নেই। পারস্য রাজ্যে যাকে আদর করে ডাকা হয় ভালোবাসার ফুল। উর্দুতে যার নাম ‘গুল-ই-লালাহ’ বা শহীদের প্রতীক। পপি গাছ এর আদি নিবাস ইউরোপে হলেও বর্তমানে এটি পৃথিবীর সর্বত্র পরিচিত তার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য। যদিও মাদক দ্রব্য উৎপাদনের জন্য পপির লাল এবং গোলাপী রঙের ফুলটাকেই সর্বাধিক প্রধান্য দেওয়া হয়। তবে লাল এবং গোলাপী ছাড়াও সাদা, হলুদ এবং নীল রংয়ের পপি ফুলকেও বিভিন্ন দেশে দেখতে পাওয়া যায়। এই ফুলের পাপড়িগুলো হয় রেশমের মতো নরম এবং ততধিক কোমল প্রকৃতির।
☆☆ পপি ফুলের পরিচয়ঃ- পপি, Plantae জগতের মধ্যে Papaver Somniferum প্রজাতির Ranunculales বর্গের Papaveraceae পরিবার ভুক্ত একটি ভয়ংকর সুন্দর ফুল। যার বৈজ্ঞানিক নাম- ‘Papaver Somniferum’. ফুল বিশেষজ্ঞদের ধারনা, পপি ফুলের এই নামকরণ করা হয় প্রাচীন গ্রীক পুরাণের ঘুমের দেবতা ‘সোমনাস’-এর নামানুসারে। কারণ পপির ক্ষেতে বয়ে যাওয়া মৃদু শীতল বাতাস এতটাই স্পর্শকাতর আর আরামদ্বায়ক যে, তা যে কোন প্রাণীদেরকেই ঘুম পাড়িয়ে দিতে সক্ষম!প্রকৃতির বুকে পাওয়া বিভিন্ন রং-এর পপি ফুল আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রূপকার্থে বিশেষ ভাবে সমাদৃত। এবং এর রং-কেও আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ জিনিসের প্রতীক হিসাবেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন বিশ্বে লাল রং-এর পপি ফুলকে মূলত মৃত্যু, স্মরণসভা, সাফল্য এবং ভালবাসার প্রতীক হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। সাদা রং-এর পপি ফুল শেষকৃত্যানুষ্টান, স্মৃতিচারণ মূলক সভা-সেমিনার এবং শান্তি পূর্ণ ঘুমের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। এবং নীল, গোলাপী এবং বেগুনি রং-এর পপি ফুলকে কল্পনা, বিলাসিতা এবং সাফল্যের অন্যতম বাঁধার প্রতীক হিসাবে দেখা হয়ে থাকে।তাছাড়া প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদের কাছে এটি প্রশান্তিদ্বায়ক, ঘুমবর্ধক এবং আনন্দদ্বায়ক হিসাবেও বেশি পরিচিত। তবে চীন এবং জাপানের কাছে লাল রং-এর পপি মূলত গভীর-প্রগাঢ় প্রেম এবং বন্ধুত্বের প্রতীক হিসাবেই বেশি সমাদৃত। আর সাদাকে তারা দেখে তাদের সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবে।ঐতিহাসিক তথ্য মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে এই ফুলটি লাগানো হয়েছিল ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদের পাশের বাগান। তাছাড়া প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যে গভীর সম্পর্কের অন্যতম প্রতীক হিসাবেও লাল পপি বিশেষ ভাবে জনপ্রিয়। এমন কি বিশ্বের কিছু কিছু দেশে সেই দেশের অন্যতম শহীদ বীরদের প্রতি সম্মান জানাতে তাদের শ্মষান-সমাধিতে পপি ফুলের পুষ্পস্তবকও অর্পণ করা হয়। নিচে তেমনই কিছু বিখ্যাত কাজে পপি ফুলের ব্যবহার উল্লেখ করা হলঃ-
☞ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন প্রায় ৮ লাখ ৮৮,২৪৬ জন ব্রিটিশ ও কমনওয়েলথ সেনা। তাঁদের স্মরণে ঠিক ততগুলো হাতে তৈরি কৃত্রিম পপি লাগানো হয়েছিল ঐতিহাসিক লন্ডন টাওয়ারের পাশের বিশাল উদ্যানে। ১১ নভেম্বর শেষ হয় এই প্রদর্শনী।
☞ একই স্থানে প্রায় ১৬ একর জমির উপরে পপি লাগানোর ফলে দূর থেকে দেখলে মনে হতো, লন্ডন টাওয়ারের আশ-পাশটা যেন রক্তের সমুদ্রে পরিণত হয়ে গিয়েছে। প্রায় ১৬টি ফুটবল মাঠ বা ২৫০টি টেনিস কোর্টের সমান জায়গায় লাগানো হয়েছিল এই ফুলগুলো।
☞ তৎকালিন সময়ে লন্ডন টাওয়ারের পাশের সেই পপির বাগান পরিদর্শন করেছিলেন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সাথে ছিলেন প্রিন্স উইলিয়ামস এবং হ্যারিসহ পুরো রাজ পরিবার।
☞ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও এই পুষ্প সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলেন। এসময় নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে তারা একটি করে ফুল লাগান।
☞ ধারনা করা হয়, পুরোনো পদ্ধতিতে প্রতিটি গাছ লাগাতে স্বেচ্ছাসেবীদের দিনে তিন শিফটে প্রায় ২৩ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়েছিল। মূলত মাটির তৈরি ফুল, ইস্পাতের ডাল আর কাঠামো তৈরি করতেই এই বিপুল সময় ব্যয় হয় তাদের।
☞ তৎকালিন সময়ে প্রায় ৪০ লাক্ষ পর্যটক এই প্রদর্শনী পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। আর তাদের বেশিরভাগই সেই প্রদর্শনী থেকে ফুল কিনেছিলেন, পরবর্তিতে যে ক্রয়কৃত টাকার সবটাই যুদ্ধে আহত সৈনিকদের ত্রাণ তহবিলেই জমা দেয়া হয়।